ছেলেবেলার কথা বলি, তখনও দস্যিপনা আর পাকাপাকা কথা বলতে শিখিনি। সমবয়সী ছেলেগুলোর চাইতে অনেকটা হাবাগোবাই ছিলাম। মানুষ যা বলতো, একটু দেরি করে বুঝতাম। স্কুলে ক্লাস ওয়ানে নতুন ভর্তি হলাম, কাউকে চিনি না। সবাই যখন এর-তার সাথে খেলছে, আমি তখন চুপচাপ এক কোণায় বসে ভাবতাম, কি করা যায়। কারো সাথে নিজে গিয়ে বন্ধুত্ব করবো, সেটাও সাহসে কুলাতো না।
একদিন টিফিন টাইমে সাহস করে ওদের সাথে খেলতে গেলাম। ওরা খেলছিল ‘টিলো এক্সপ্রেস’ জাতীয় কি জানি একটা খেলা, অর্থাৎ সবাই লুকাবে, আর কেউ একজন খুঁজে বের করবে। সবাই কাছাকাছিই লুকায়, যেন তাড়াতাড়ি কেউ খুঁজে বের করতে পারে। আমি তো কম বুঝতাম, চলে গেলাম স্কুলের বিশাল মাঠ পাড়ি দিয়ে ঐ পাশের স্কুলের মসজিদে। কিন্তু ওদিকে কেউ তো আর আমাকে খুঁজতে আসেনা! পুরো টিফিন পিরিয়ড সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম, কেউ আসলো না। ঘন্টা দেয়ার পর চুপচাপ এসে ক্লাসে বললাম।
আরেকদিনের কথা, স্কুলের ড্রইং ক্লাসে ম্যাডাম কোনো একটা ফলের ছবি আঁকতে দিয়েছেন। আমরা সবাই আঁকছি, আঁকা শেষে ম্যাডামকে দেখালে উনি সেখানে নাম্বার দিয়ে দিচ্ছেন। সবাইকেই দশে সাত-আট এরকম দিচ্ছেন। আমার খাতায় লিখলেন ‘V. Good’, এর মানে হলো ভেরি গুড, কিন্তু আমি সেটা জানতাম না। সেদিন ভয়ে বাসায় খাতাই দেখাইনি, পরদিন ড্রইং ক্লাসে আরেকটা ফলের ছবি আঁকতে দিলেন, এবারো আমার খাতায় লিখলেন ‘V. Good’। অবশেষে দুই দিন পরে ভয়ে ভয়ে বাসায় খাতা দেখালাম, এমনই বোকা আমি!
এবার বাবার কথা বলি, অন্য কেউ হলে হয়তো হালই ছেড়ে দিতো, কিন্তু এইরকম হাবাগঙ্গারাম ছেলের ওপর কেন যেন কখনোই আস্থা হানাননি তিনি। ছেলেবেলায় যেখানেই আমাকে নিয়ে যেতেন, বলতেন, ওকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবো। বাসায় কোন খুটখাট করলে আদর করে ডাকতেন, এই যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, এদিকে আসেন!
যে বয়সে সবাই ছোঁয়াছুয়ি আর কুমির-কুমির খেলে বেড়াতো, আমি সেই বয়স থেকেই বইয়ের পোকা। স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায়ই নীলক্ষেত যেতাম। তারপর ফুটপাথের প্রতিটা দোকান আঁতিপাতি করে বই বাছতাম। পছন্দ হলে মনে মনে ঠিক করে রাখতাম, কিছুদিন টিফিনের পয়সা জমিয়ে সেই বইটা কিনতাম। একবার স্কুলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মেলা হচ্ছিল। একটা বই খুব পছন্দ হলো, চার্লস ডিকেন্সের ‘গ্রেট এক্সপেকটেশন্স’ এর বাংলা অনুবাদ। আমার কাছে টাকা নেই, পকেটে ছিল স্কুলের বেতনের টাকা, সেটা দিয়েই কিনে ফেললাম।
ছুটির পর আমাকে নেয়ার জন্য বাবা আসলে তাকে জানালাম, বাবা কিছুই বললেন না। তবে আগে থেকে না জানিয়ে খরচ করাতে হালকা বকুনি দিলেন। বাবা রাগ করলেন কিনা বুঝলাম না।
এর কিছুদিন পরের কথা, বাবার কিছু বন্ধু বাসায় এলেন, কথায় কথায় বাবা বললেন, ‘তোমরা এটাও পড়োনি!, অথচ আমার ছেলে এই বয়সেই ‘গ্রেট এক্সপেকটেশন্স’ পড়ে ফেলেছে।’ আড়াল থেকে সেকথা শুনে বুঝতে পেরেছিলাম বাবা আসলে কত খুশি হয়েছিলেন।
স্কুল জীবনের শেষদিককার কথা, বোধহয় টেন এ পড়ি। একুশে টিভি তখন টেরিস্ট্রিয়াল ছিল, ডিশ লাইন ছাড়াই দেখা যেত, সেখানকার কুইজ শো ‘জানা অজানা’ তে অংশ নেবে আমাদের স্কুল। আমি আর আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন শো এর জন্য নির্বাচিত হলাম। টানা দুই দিন শুটিং হলো কুইজ শো এর। পুরো দুইটা দিনই বাবা আমার সাথে ছিলেন। এক একটা রাউন্ড শেষ হতো, দেখতাম বাবা এক বোতল পানি, অথবা একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মাঝে মাঝে বিরতিতে কারেন্ট চলে গেলে পাখা দিয়ে বাতাস করতেন, কোত্থেকে যে পাখা যোগাড় করতেন কে জানে। সেখানে নামাযের ব্যবস্থা ছিলনা, নামাযের সময় হলে বাবা ঘুরে ঘুরে জায়গা খুঁজে বের করতেন। এমনও সময় গিয়েছে, অডিটরিয়ামের এক কোনায় ছেঁড়া পোস্টারের ওপর আমরা দুইজনে নামায পড়েছি। চ্যাম্পিয়নের ট্রফিটা হাতে নিয়ে আমার মনে হয়েছিল, এ ট্রফিটা বাবারই প্রাপ্য। আমার মত বোকাসোকা আর নির্বোধ টাইপের একটা ছেলের ওপর যে আস্থা রেখে এতদূর নিয়ে আসতে পারে, সে ই তো আসল বিজয়ী।
আমার ছোটবেলার তুচ্ছ ঘটনাগুলো মনে করে বাবা এত মজা পেতেন যে বলার মত নয়। ছোটবেলায় আমি কিভাবে মাথার ওপর বালিশ নিয়ে ‘লেবু লেবু’ বলে ফেরিওয়ালা সাজতাম, সেটা প্রায়ই বাবা খুব আগ্রহ নিয়ে অভিনয় করে দেখাতেন। আর আমি তখন লজ্জায় লাল হতাম।
বাবার শেষবেলায় বাবার সাথে থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। অফুরান প্রাণশক্তি আর কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর আমার বাবাটাকে কিছুতেই বিছানায় শোয়া অবস্থায় মেলাতে পারতাম না। মনে হতো, এই বুঝি উঠে বলবেন, কইগো, জুতাটা দাও, একটু বাইরে যেতে হবে’।
নিজে কষ্টে থেকেছেন, কিন্তু আমাদের লেখাপড়ায় কখনোই ঘাটতি হতে দেননি। ছেলেমেয়েদের প্রতি অসম্ভব আস্থা আর বিশ্বাস ছিল তাঁর। অনেক ভুল করেছি, কিন্তু বাবা সবসময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, বিশ্বাস রেখেছিলেন যে তার ছেলেমেয়েরা পারবে। অন্য সবাই যেখানে নিশ্চিত হাল ছেড়ে দিতো, বাবা সেখানেও ভাবতেন, পারলে আমার ছেলেমেয়েরাই পারবে। আকাশের মত বিশাল হৃদয় না হলে এ সম্ভব নয়।
আব্বু, এখন কেউ আর তোমার মত বলে না, ‘এই যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, এদিকে আসেন।’, আমার বিশ্বাস তুমি অনেক ভাল আছো। তোমার ছেলে এখন সত্যিকারের ইঞ্জিনিয়ার হবার পথে, কিন্তু সেটা দেখার জন্য তুমি নেই। আকাশের মত বিশাল হৃদয়ের তোমাকে খোঁজার জন্য তাই মাঝে মাঝে আকাশের দিকেই তাকাই….
(রচনাকালঃ মার্চ, ২০১২)