শহরের মধ্যে জেল আর জেলের মধ্যে আরেক শহর

মূল লেখার লিংক

জেলখানা শব্দটা শুনলেই আমাদের মনে কি ভেসে উঠে বলুনতো? অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা দালান আর স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া, যেখানে সাজাপ্রাপ্ত আসামীরা বসে বসে নিজের প্রায়শ্চিত্ত করছে। প্রতিদিনই তারা অপেক্ষায় থাকে, এই বুঝি দেখা করতে এলো স্ত্রী, সন্তান বা আত্মীয়-স্বজন। কারোর অপেক্ষার পালা ফুরোয়, আবার কেউ অপেক্ষা করতেই থাকে। আমাদের এক স্যার বলেছিলেন, “এসব আসামীদের শাস্তি নাকি জেল-জরিমানা কোনো কিছুই না, এদের শাস্তি নাকি নিজের পরিবারের আর আপন মানুষদের কাছ থেকে দূরে থেকে যে মানসিক কষ্ট পায় সেটা”।

পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানারকম জেলখানা আছে। এদের কোনটা আধুনিক এবং মানবিক সুবিধা সম্পন্ন, কোনটা মাঝারি মানের, আবার এমনও জেলখানা আছে যারা নরকের সমকক্ষ। আজ আপনাদের এমন এক বিচিত্র জেলের কথা বলব, যা জেনে আপনাদের মনে জেল সম্পরকে ধারণাই পাল্টে যাবে।

সান পেড্রো জেল, নাম শুনলে মনে হবে আর আট-দশটি জেলের মতই। কিন্তু না!
বলিভিয়ার লা-পাজ এ অবস্থিত এই জেলটি সেখানকার সবচেয়ে বড় জেল। সেখানে ১৫০০ জন কয়েদীর জন্য জায়গা আছে। তবে জেলের বিচিত্রতা তার জনসংখ্যায় বা আয়তনে নয়, এটি পরিচিত তার নিজস্ব সামাজিক ব্যাবস্থা আর বিধানের জন্য। সান পেড্রো জেলখানাটি আপাদমস্তক একটি শহরের মত। এখন আমি আপনাকে এই শহরটি ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব নিলাম। আসুন তাহলে আমার সাথে…


সান পেড্রো কারাগারের রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি

জেলখানাটির ধারণক্ষমতা ৬০০ জনের হলেও এতে বর্তমানে কয়েদি আছে দেড় হাজার জন এবং তাদের স্ত্রী- সন্তানসহ প্রায় তিন হাজার জন মানুষ এই জেলের বাসিন্দা। যখন কোনো নতুন কয়েদি এখানে আসে, তখন তাকে প্রিজন মেয়র বা কোনো ফ্রিল্যান্স কয়েদি রিয়েল এস্টেট এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তারা প্রত্যেকেই আপনার সাথে কমিশন এজেন্ট রূপে কাজ করবে। জেলে পোস্টা, পিনোস, আল্মোস, সান মারটিন, প্রিফেকচুরা, পাল্মার, গুয়ান্নে এবং চাঞ্চা নামে আলাদা আলাদা হাউজিং সেকশন আছে। সুবিধভেদে সেখানে সেলের দাম ৫০ ডলার থেকে ২৫০০ ডলার পর্যন্ত। এদের মধ্যে পোস্টা, পিনোস আর আল্মোস হচ্ছে উচ্চস্তরের বা বড়লোকদের এলাকা, আর বাকিরা এদের চেয়ে নিম্ন। সব এলাকাই ছোট ছোট গ্রামের মত অংশে বিভক্ত এবং প্রত্যেক অংশেই উঠান, রেস্টুরেন্ট, মার্কেট, ইনডোর-আউটডোর গেমের জায়গা, ক্যান্টিন এবং সার্ভিস ব্যাবস্থা থাকে। সবার জন্য ব্যাংক, হাসপাতালের ব্যাবস্থাও আছে। বড়লোকদের এলাকায় বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে আছে প্রাইভেট বাথরুম, রান্নাঘর, টিভি এবং হট বাথটাব। কেউ কেউ চাইলে একটু-আধটু নেশাও করতে পারে। এসবের জন্য আপনাকে ১৫০০-১৮০০ ডলার খরচ করতে হবে। তবে বড়লোকের সংখ্যা সেখানে তেমন বেশি না। আর অন্য এলাকাগুলোতে থাকে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এবং গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত আসামিরা।


এমন দোকানপাঠ এবং রেস্তোঁরার দেখা পাবেন এই কারাগারের পথে পথে

জেলখানার জায়গা-সম্পত্তি কেনার জন্য প্রথমে ২০-২৫% অফেরতযোগ্য ফি দিতে হবে বিক্রেতা কয়েদীকে। এই ফি ব্যয় করা হয় জেলখানা কম্যুনিটি পরিচালনা, প্রশাসনিক কাজ, জেল পরিষ্কার রাখা এবং মেরামতে। তাছাড়া বিভিন্ন বিশেষ দিবস, যেমন প্রিজনার’স ডেতে এসব টাকা খরচ করা হয়। প্রত্যেক কয়েদির কাছে তার সেকশনের বিবরণযুক্ত পেপার থাকে যাতে রুম নাম্বার, লোকেশন, আগের মালিকের নাম, বিক্রয়মুল্য এবং রুমের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থাকে। বিক্রি করতে ইচ্ছুক কয়েদি এই বিবরণ তাদের সেকশন লিডারকে দেয়, ক্রেতা কয়েদি বিবরণটা পড়ে দেখে। পরে সেকশন লিডার এবং একজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে এই বিনিময়-চুক্তি সম্পন্ন হয়। সবশেষে সেকশন লিডার তাতে অফিসিয়াল সিল মেরে দেয়। কারো যদি আস্ত একটা সেল কেনার টাকা না থাকে তাহলে সে কোনো কয়েদির কাছ থেকে মাসিক ভাড়ার বিনিময়ে একটা রুম নিতে পারে।

এখানে প্রশাসন হিসেবে থাকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত আটটি সেকশন কমিটি। প্রত্যেক কমিটির একজন ইনচার্জ থাকেন। তিনি মেরামত, দেয়াল রঙ করা সহ অন্য কাজকর্ম সমন্বয় করেন। এছাড়াও আছে কোষাধ্যক্ষ, সংস্কৃতি সম্পাদক, শিক্ষা সম্পাদক সহ বিভিন্ন পোস্ট। আপনি যদি এসব পোস্টে নির্বাচন করতে চান, তবে আপনার জেলখানায় বসবাসকাল কমপক্ষে ছয় মাস হতে হবে এবং কোনো উল্ল্যেখযোগ্য দেনা থাকা চলবে না।

সান পেড্রো জেলের বাসিন্দারা নিজেরাই আইন বানিয়ে নিয়েছেন। রিসেপশন কমিটি নতুন আসা কয়েদিদের এই আইন সম্পর্কে জানিয়ে দেয়। নিজস্ব গার্ড ছাড়াও প্রত্যেক সেক্টরে একজন নির্বাচিত লিডার আর ফিনান্সিয়াল সেক্রেটারি থাকে। ডিসিপ্লিনারি পরিচালকের হাতে থাকে শাস্তির দায়িত্ব। কোনো কয়েদি দোষ করলে তাকে আইসোলেশন সেলে পাঠানো হয়। সেখানে অফিশিয়াল প্রিজন গার্ডরা থাকেন এবং তাদের চেক দেন। আইসোলেশন সেলে নরমাল সেলের মত অত স্বাধীনতা থাকেনা। এরপরও যদি সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি আবার অন্যায় করে বসে ,তবে তার জন্য আছে আরো কড়া সিকিউরিটি এবং নূন্যতম সুবিধার “করঞ্চো সেল”। এখানে কিন্তু ধর্ষক বা শিশু নির্যাতনকারীদের তেমন ভালো চোখে দেখা হয়না। তারা বেশিরভাগ জেলের কয়েদীদের হাতে মারা যান।


সান পেড্রো কারাগারের কোকেন ল্যাব

জেলখানাতেই বসে আয়ের জন্য আপনার হাতে আছে অফুরন্ত সুযোগ। জেলের মধ্যে আপনি দোকান দিতে পারবেন, রেস্টুরেন্ট চালাতে পারবেন, হাতে তৈরি জিনিসপত্র বানিয়ে ট্যুরিস্টদের কাছে বিক্রিও করতে পারবেন। অনেকেই টুরিস্ট গাইড হিসেবে কাজ করেন, এছাড়া নাপিত, বার্তা বাহকের কাজও রয়েছে। তবে সান পেড্রো জেলখানার সবচেয়ে বড় আয় আসে কোকেইন ব্যাবসা থেকে। জেলের মধ্যে ড্রাগ উৎপাদনের ল্যাবরেটরি রয়েছে এবং কয়েদিরা নিজেদের সেলেও ক্রুড পদ্ধতিতে ড্রাগ বানিয়ে থাকেন। সেই ড্রাগ বাজারে বহুমূল্যে বিক্রয় করা হয়। ড্রাগের মার্কেটে সান পেড্রো জেলখানা একটি বড় সাপ্লাইয়ার রূপে পরিচিত।

এসব ছাড়াও জেলের মধ্যে জুয়া খেলা চলে। প্রতিবছর ইন্টার-সেকশন ফুটবল ম্যাচে কমপক্ষে ২০,০০০ ডলারের জুয়ার টাকা লেনদেন হয়। বলিভিয়ান এই জেলের বিশেষত্বগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এখানে কয়েদির সাথে তার পরিবার-পরিজন থাকতে পারে। মহিলারা তাদের স্বামীর ইনকাম ছাড়া বাইরে বসবাস করতে পারবেন না, তাই এখানেই চলে আসেন। তবে কয়েদীদের পরিবার-পরিজনরা জেলের বাইরে আসা যাওয়া করতে পারেন। তারা বাইরে থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি নিয়ে আসেন জেলের দোকানে বিক্রি করার জন্য।


কারাগারের মাঝে এক উৎসবের দিনে

সান পেড্রো জেলে কমপক্ষে ২০০ বাচ্চা থাকে এবং এসব বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য জেলের মধ্যেই ২টা নার্সারি আছে। বাচ্চা-কাচ্চারা পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে এবং স্কুল শেষে জেলখানায় চলে আসে। সেপ্টেম্বরে প্রিজনারস ডে হল জেলখানার সবচেয়ে বড় উৎসব। এই উৎসবে সেকশন লিডার বারবিকিউর আয়োজন করেন এবং লাইভ কনসার্টের জন্য ব্যান্ডদলও ভাড়া করা হয়। অনেক কয়েদি সেই অনুষ্ঠানে পারফর্ম করার সুযোগ পান।


সান পেড্রো কারাগারে বেড়ে ওঠা শিশুরা

জেলের শতকরা ৮০ভাগ লোকই ড্রাগ-রিলেটেড মামলায় অভিযুক্ত। প্রতিমাসে জেলে প্রাকৃতিকভাবে বা সংঘর্ষের কারণে গড়ে ৪ জন লোক মারা যায়। পুলিশ খুব কমই জেলখানার ভিতর প্রবেশ করে। অন্যান্য দেশের তুলনায় এই জেলখানার কয়েদিরা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ পান। তাই রাজনীতিবিদরা এখানে এসে তাদের সাপোর্ট পাওয়ার চেষ্টা করেন।

আপনি যদি চান তবে সান পেড্রো জেলখানাটি ঘুরে আসতে পারবেন। ট্যুরিজমের কাজটি আইনবহির্ভূত হলেও পর্যটকরা কর্তব্যরত গার্ডদের ঘুষ দিয়ে এখানে ঢুকতে পারেন। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনো কয়েদি এই সুযোগে বেরিয়ে আসতে না পারে। যারা এই জেল-ভ্রমনে যেতে ইচ্ছুক তাদের প্রথমে এমন একজন মানুষকে লাগবে যিনি জেলখানার বিস্তারিত জানেন। তারপর পর্যটককে একটা রুমে নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখানে ৫৭ ডলার বা ৪০০ বলিভিয়ান টাকা জমা দিতে হবে। টাকা জমা দিয়ে তাদের নাম আর পাসপোর্ট নাম্বার একটি রেজিস্ট্রি বুকে টুকে রাখা হবে। এরপর রেজিস্ট্রি বুকের সিরিয়াল নাম্বার অনুযায়ী তাদের বাহুতে একটি নাম্বার লাগিয়ে দেওয়া হবে। এই নাম্বারটি হবে তাদের ট্যুরিস্ট হিসেবে আইডেন্টিফিকেশন এবং ট্যুর শেষ হয়ে গেলে এই নাম্বারটি দেখিয়ে তারা জেল থেকে বের হতে পারবেন। ট্যুরিস্টদের সাথে একজন গাইড আর বডিগার্ড দিয়ে দেওয়া হবে। জেলখানাতে ছবি তোলা নিষেধ আর সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে ট্যুরিস্টকে জেলখানা ত্যাগ করতে হবে। এর মাঝখানে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আপনি ট্যুরিসট হোটেলও পাবেন। এত নিয়ম-কানুনের ঝামেলা এবং দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকার পরও প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ জন মানুষ এই অদ্ভুত নিয়মের জেলটি দেখতে আসেন।


এই পর্যটকের মত আপনিও ঘুরে আসতে পারেন এবং দেখে আসতে পারেন অদ্ভুত এই কারাগারের জীবনযাত্রা

এই হল সংক্ষেপে সান পেড্রো জেলখানার বর্ণনা। অন্যান্য জেলখানাগুলোর তুলনায় এখানে একটু বেশি সুযোগ সুবিধা আছে। কিন্তু তারপরও মুক্ত পৃথিবীতে চলাফেরা আর জীবনযাপনের স্বাদই আলাদা, তাই নয় কি?

লেখাটির ব্যাপারে আপনার মন্তব্য এখানে জানাতে পারেন