গ্রায়েম স্মিথ- ক্রিকেট মাঠের গ্ল্যাডিয়েটরের গল্প

মূল লেখার লিংক
গ্রায়েম স্মিথ- ক্রিকেট মাঠের গ্ল্যাডিয়েটরের গল্প!

সময়কাল জানুয়ারি ২০০৯।

সিডনীতে সিরিজের তৃতীয় টেস্টের শেষদিন, দুশো সাতান্ন রানে দক্ষিণ আফ্রিকার নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হলেন ডেল স্টেইন। অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথের কবজি ভেঙেছে প্রথম ইনিংসেই, ব্যাট হাতে তিনি নামবেন, এমনটা ভাবনায় ছিল না কারো। প্রথম দুই টেস্ট জিতে সিরিজ আগেই নিজেদের করে নিয়েছে প্রোটিয়ারা, শেষবেলায় কার এত দরকার পড়েছে শুধু শুধু ঝুঁকি নেয়ার! ম্যাচ শেষ হয়ে গেছে ধরে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়েরাও তখন আনন্দে মত্ত।

ধারাভাষ্যকার মার্ক নিকোলাস চেঁচিয়ে উঠলেন ঠিক তখন! “Wait a minute! Wait a minute! What’s happening? Graeme Smith is coming with the bat!” উল্লাসরত অস্ট্রেলিয়া দলও সেই মূহুর্তে খানিকটা হতভম্ব। ড্রেসিং রুম থেকে ধীরপায়ে নেমে এলেন ক্যাপ্টেন, ভেঙে যাওয়া বামহাতে ব্যাট ধরতে পারছিলেন না, সেটাকে ডানহাতে নিয়েই ঢুকলেন মাঠে।

গ্যালারি থেকে করতালির বন্যা, প্রতিপক্ষ অধিনায়ককে অভিনন্দন জানাতে কার্পণ্য করছিলেন না স্বাগতিক দর্শকেরা। অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে বীরের মর্যাদা অন্যরকম, যোগ্য ব্যক্তিকে তারা বরাবরই সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে বসায়। সাতই জানুয়ারীর দিনটাতেও এর ব্যতিক্রম হলো না। জয়ের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ব্যবধান তখন এক উইকেটের, দক্ষিণ আফ্রিকার জয় অসম্ভব ব্যাপার, পঞ্চম দিনের শেষ ছয়টা ওভার কাটিয়ে দিতে পারলেই ম্যাচটা ড্র করতে পারবে তারা। ভাঙা হাত নিয়ে ব্যাটটা কোনমতে ধরে স্মিথ নেমে এসেছিলেন দলকে পরাজয় থেকে বাঁচাতেই!

মাত্রই উইকেট পাওয়া ম্যাকডোনাল্ডকে সরিয়ে মিশেল জনসনকে নিয়ে এলেন পন্টিং, অন্য প্রান্তে আগে থেকেই মজুদ ছিলেন বোলিঞ্জার। এই জনসনই প্রথম ইনিংসে কবজি ভেঙে দিয়েছিলেন স্মিথের। আক্রমণে এলেন পিটার সিডলও। পান্টারের উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার, নিজের সবচেয়ে শক্তিশালী তোপ দেগে প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দেয়া, গতির ঝড়ে বেসামাল করে দিতে চাইলেন স্মিথকে। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অসীম বীরত্বের একটা নাটক মঞ্চস্থ হয়ে গেল পরের কয়েক মিনিটে। এরমধ্যে বলিঞ্জারের বলে স্লিপে ক্যাচ পড়েছে মাখায়া এনটিনির।

3-8

দিনের খেলা শেষ হতে তখনও আধঘন্টার বেশী বাকী। জনসন একের পর এক ছুঁড়ে মারছেন ১৪০ কিলোমিটারের বেশী গতির আগুনের গোলা, একেকটা বল পড়ছে ইয়র্কার লেন্থে, কখনও কোমর সোজা ছুটে আসছে বুলেটের মতো। স্মিথ কোনমতে ব্যাটটা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আক্রমণটাই সবসময় বীরত্বের গল্প বলে না, তলোয়ারের বদলে কখনও ঢাল নিয়ে দাড়ানোটাও বীরের কাজ। একেকটা বল খেলার পরে স্মিথের মুখভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছিল, কতটা কষ্ট হচ্ছে তাঁর। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলেন স্মিথ, বলের গতিতে ব্যাটের দিক ঘুরে গেল, স্মিথ টললেন না। একটাই শুধু লক্ষ্য, ছয়টা ওভার, আধঘন্টা সময় যেভাবে হোক টিকে থাকতে হবে। টিভি ক্যামেরায় ড্রেসিং রুমের ভেতরে থাকা মার্ক বাউচারের উদ্বিগ্ন চেহারাটা ধরা পড়লো, একেকটা বলে স্মিথ ডিফেন্স করছেন, আর হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলছেন বাউচার!

প্রায় মিনিট পঁচিশের সংগ্রাম শেষ হলো জনসনের বলেই, ব্যাট প্যাডের ফাঁক গলে বলটা ঢুকে গিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দিল স্মিথের স্ট্যাম্প। জয়ের আনন্দ তখন অস্ট্রেলিয়া শিবিরে, কিন্ত বিজেতাদের দলেও তো একজন জয়ী আছেন। সবাই এসে হাত মিলিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সঙ্গে, অসীম সাহসে যিনি ভাঙা হাত নিয়ে নেমে এসেছিলেন দলের পরাজয় রুখে দিতে! গ্রায়েম স্মিথ- সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিতেন যে মানুষটা! প্রথম দুই টেস্টে দুর্দান্ত ব্যাটিং করেছিলেন, দল জিতেছিল, সিরিজিসেরাও হয়েছিলেন স্মিথ। শেষ টেস্টের শেষবেলায় মাঠে না নামলে কেউ আঙুল তুলতো না তাঁর দিকে। কিন্ত প্রফেশনালিজম বোধহয় একেই বলে! কিংবা নিজের দায়িত্বটুকু পালন করলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না- এটা গ্রায়েম স্মিথের কাছে শেখা যেতে পারে।

সাফল্যের বিচারে হোক কিংবা স্থায়িত্বের; পরিসংখ্যান সাক্ষী দিচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের সেরা অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ। ‘ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দ্যা ফ্রন্ট’- ক্রিকেট অধিনায়কদের বেলায় কথাটা খুব অল্প যে কয়টা মানুষের নামের সঙ্গে যায়, স্মিথ তাঁদের একজন। যিনি শারীরিক কষ্টকে উপেক্ষা করে জিতে যাওয়া সিরিজের ‘মূল্যহীন’ একটা টেস্ট বাঁচাতে নেমে আসতে পারেন মাঠে, ভাঙা কবজি নিয়ে মুখোমুখি হতে পারেন মিশেল জনসনের মতো গতিদানবের, তাঁকে তো ক্রিকেটের গ্লাডিয়েটর বললেও কম বলা হয়!

হয়তো এসব কারণেই ক্রিকেটটা এত সুন্দর, এত রহস্যের, এত রোমাঞ্চের। এইসব মায়াবী গল্পের জন্ম হয় বলেই ক্রিকেটকে ভালোবাসা, ক্রিকেটে বাস করা, ক্রিকেটে বেঁচে থাকা!

লেখাটির ব্যাপারে আপনার মন্তব্য এখানে জানাতে পারেন