হরেক নামের ঢাকা

মূল লেখার লিংক

ঢাকা নামের নগরের আনুষ্ঠানিক শুরু সেই ১৬১০ (মতান্তরে ১৬০৮), মোঘলদের হাতে। বাংলা ছিল প্রায় সবসময়ই বিদ্রোহী, অধিকাংশ সময় প্রায় স্বাধীন। এ কারণে নানা ঝড়-ঝাপটা, উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে এ নগরী, বার বার পেয়েছে ও হারিয়েছে রাজধানীর সম্মান। সামরিক ছাউনি বা সাম্রাজ্যের শেষ সীমানায় প্রতিরোধ কেন্দ্র থেকে কখনো পরিণত হয়েছে বন্দরশোভিত বাণিজ্য নগরীতে। নানা পট ও পালাবদলের খেলায় ঢাকায় সমাগম হয়েছিলো নানা জাতের, নানা দেশের নানান কিসিমের মানুষের, সামরিক ও বাণিজ্যিক বিভিন্ন উদ্দেশ্যে। একাধিক প্রশাসনের অধীনে, নানান সময়ে, নানা কর্মজীবীর কর্মে বা বসতির নামে বিভিন্ন ভাষায়, নাম হয়েছে ঢাকার পুরনো বিভিন্ন স্থানের। তেমন কয়েকটি স্থানের নাম নিয়ে এ লেখা।

বোম্বের পার্সি টাওয়ার অফ সাইলেন্স, এমনই ছিল ঢাকারটিও

গজমহাল

ঢাকায় পিলখানা ছিল, এলিফ্যান্ট রোড ছিল, আর ছিল হাতি। শুধু ত্রিপুরা, আসাম না, বৃহত্তর ঢাকা জেলাও বিখ্যাত ছিল হাতি ধরা ও খেদার জন্যে। তবে কোম্পানি আমলের শেষের দিকে ক্রমান্বয়ে বাড়ন্ত শহরের সাথে সাথে, ঢাকার আশেপাশে হাতির সংখ্যাও কমতে থাকে। শুধু ঢাকার পিলখানার হাতির গোসলের জন্যেই রমনায় জলাশয় বরাদ্দ করা হয়, আর হাতিরা যে পথে যাতায়াত করতো, তার নাম হয়ে যায় এলিফ্যান্ট রোড।

কিন্তু এর বাইরে নদীতে নিয়ে হাতি গোসল করানোর জন্যে আরেকটি মহালও বরাদ্দ ছিল, যার নামই ছিল গজমহাল। অবশ্য নদী তখন বয়ে যেত আরো শহর ঘেঁষে, এবং জায়গাটি ছিল জলা। আজিমুশশানের উল্লেখ  অনুসারে বর্তমান নবাবগঞ্জ ছিল গজমহাল। অবশ্য ঢাকার পুরনো মৌজা ম্যাপে দেখা যায়, বর্তমান ট্যানারি মোড় ও টালি অফিস এলাকা থেকে একটু পিছনে নদীর সাথেই ছিল এই গজমহাল।

অবশ্য ঐতিহাসিকদের কারো কারো মতে, মোঘল আমলে পিলখানা ছিল বর্তমান পিলখানা এলাকার আরো উত্তরে, সেক্ষেত্রে প্রাচীন পিলখানার হাতি গোসলের স্থানই হয়তো ছিল গজমহাল। প্রাচীন পিলখানার অস্তিত্ব অবশ্য এখন আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

ধোলাইখালের পানি দিয়েই তৈরি হত সরকারি ডিস্টিলারির মদ

ডিস্টিলারি রোড

ঢাকার ধূপখোলার বেশ লম্বা একটি রাস্তার নাম ডিস্টিলারি রোড। সেখানে ইংরেজ আমলে ছিল সরকারি ডিস্টিলারি বা মদ্য উৎপাদনকেন্দ্র ও শোধনাগার। বাংলায় যাকে বলা হতো ভাটিখানা। ১৮৮৫ সালের এক সরকারি চিঠি থেকে জানা যায়, শুষ্ক মৌসুমে ধোলাইখালের পানি কমে যাওয়ায় ডিস্টিলারির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছিলো কারণ এই খালের পানিই ব্যবহৃত হতো মদ উৎপাদনে। পানীয় উৎপাদনে সারাবছর প্রয়োজন নিরবিচ্ছিন্ন পরিষ্কার পানি, তাই প্রস্তাব করা হয়েছিল বুড়িগঙ্গা থেকে দয়াগঞ্জ পর্যন্ত খাল পুনঃখননের।

আতিশখানা

ঢাকায় মোঘলদের সাথে ছিল কিছু পার্সিরও বসবাস এবং হাকিম হাবিবুরের মতে, লালবাগ দুর্গের পিছনে তাদের উপাসনার জন্যে অগ্নিকুণ্ড ও অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্নের জন্যে ছিল একটি টাওয়ার অফ সাইলেন্স। বিংশ শতকে সেটির চিহ্ন মনে হয় আর অবশিষ্ট ছিল না। ১৯২৭ সালের এক খননে সেই উপাসনালয়ের কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। ফারসিতে আতশ মানে আগুন, আর পার্সিরা ছিল অগ্নিউপাসক ও তাদের অন্তেষ্টিক্রিয়ার অন্যতম অনুষঙ্গও ছিল আগুন। এছাড়াও আরো খানিকটা দক্ষিণ-পূর্বে, হাকিম হাবিবুর রহমান রোড ও চম্পাতলী লেনের কাছে খানিকটা নদীর দিকে (সোয়ারীঘাট এলাকায়) এক পার্সির কবর (সমাধিস্থল) ছিল বলেও হাকিম হাবিবুর রহমান তার ‘আসদুগানে ঢাকা’-তে উল্লেখ করেছেন (অন্তত ১৮৮০ সাল পর্যন্ত কবরটি টিকে ছিল)। অবশ্য সেসময়েই কবরটি (সমাধিস্থল) প্রায় ৮ ফিট মাটির নিচে চলে গিয়েছিলো এবং তার উপরে দালান কোঠাও উঠেছিল।

যদিও হাকিম হাবিবুরের সাথে পুরোপুরি একমত হননি আজিমুশশান হায়দার ও নাজির হোসেন, তারা মনে করেন এ এলাকায় থাকতো মোঘলদের গোলন্দাজ বাহিনী ও তাদের সরঞ্জাম-গোলাবারুদ, তা থেকে এই নাম। দুর্গের এত কাছে হওয়ায় দ্বিতীয় মতটিই সম্ভবত অধিক গ্রহণযোগ্য। সেক্ষেত্রে পার্সিদের বসতি গড়ার আগে থেকেই হয়তো বর্তমান লালবাগ কেল্লার পশ্চিমের এলাকা ও রাস্তাটির নাম হয়েছিল আতশখানা/ আতিশখানা।

ইস্কাটন

বাণিজ্যকেন্দ্র ঢাকায় আগমন ঘটেছিলো নানা দেশের, নানা জাতের বণিকের। তাদের নামে নামকরণ হয়েছিল ঢাকার নানা এলাকার, হয়তো সে এলাকাতেই ছিল তাদের বাণিজ্য কুঠি। বিখ্যাত আরমানিটোলাতো এমনই এক উদাহরণ, স্কটিশদের নামও জড়িয়ে গিয়েছে একটি এলাকার নামকরণে। একটা সময় ঢাকার পাটের একচেটিয়া ব্যবসা ছিল স্কটিশদের হাতে। ঢাকার স্কটিশ বসতি তাই পরিচিত হয়ে ওঠে ইস্কাটন নামে। সেখানে তারা একটি চার্চও স্থাপন করেছিলো। বর্তমানে এ শহরে স্কটিশদের কিছু কবর ছাড়া আর উল্লেখযোগ্য কোন চিহ্ন পাওয়া যায়না।

হাতির রাস্তা!

পুরানো নাখাস

শুধু ঢাকা না, একসময় পুরো পূর্ববঙ্গ বা ভারতবর্ষেই দাস ব্যবসার রমরমা ছিল। পর্তুগিজদের সন্দ্বীপ দাস ব্যবসা ও লুটতরাজের জন্যে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল, পরে ওলন্দাজরাও এ ব্যবসা করতে শুরু করে। তবে মোঘল সাম্রাজ্যেও কিন্তু দাস ব্যবসা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক কারবার। ঢাকার বর্তমান চকবাজারের যেখানে দাস বিক্রিবাট্টা হতো সে স্থানের নাম হয়ে যায় পুরানো নাখাস। নাখাস ফারসি শব্দ যার অর্থ দাসবাজার।

এসব নামের অধিকাংশই আজ আর বেঁচে নেই। যেমন মৌজা ম্যাপ থেকে গজমহালের খোঁজ পাওয়া গেলেও, সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না কোথায় ছিল সেই পুরানো নাখাস, বের করা যায় না আতিশখানা, স্কটিশদের আবাস বা ডিস্টিলারির সঠিক অবস্থান। রাস্তার নামগুলো টিকে গেলেও এলাকাগুলোর হয়েছে নতুন নামকরণ, বর্তমান প্রজন্মের অনেকে হয়তো সে নতুন নামেই চিনে তার আবাস বা কর্মস্থলকে। তবে যতদিন পুরনো দলিলপত্রাদি, বই ও সে যুগের মানুষের স্মৃতিকথাগুলো আছে, ততদিন এ স্থানগুলো খুঁজে বের করা যাবে ও জানা যাবে নামকরণের ইতিহাস। ঢাকার রাজনৈতিক ইতিহাসের চেয়ে এই নামের ইতিহাসও কম চিত্তাকর্ষক নয়।

তথ্যসূত্রঃ

1. Azimusshan Haider, “Dacca: History and Romance in Place Names: An Analytical Account of the Nomenclature of Roads and Localities in Dacca, with a Discussion of the Rationale for Their Retention Or Otherwise”, Dacca Municipality, 1967

২। নাজির হোসেন, ‘কিংবদন্তির ঢাকা’, থ্রী স্টার কো-অপারেটিভ মালটিপারপাস সোসাইটি লিঃ, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৯৫

৩। মুনতাসীর মামুন, ‘ঢাকা স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী’, বাংলা একাডেমী, জুন ১৯৯৩

৪। স্যার চার্লস ডয়লি, ‘ঢাকার প্রাচীন নিদর্শন’, একাডেমিক প্রেস এন্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি (এপিপিএল), ২০১১

৫। হাকিম হাবিবুর রহমান, ‘আসদুগানে ঢাকা’

লেখাটির ব্যাপারে আপনার মন্তব্য এখানে জানাতে পারেন