মুসলিমদের নাম নিয়ে থাকা অমুসলিমরাঃ ১ – বাহাই ধর্মমত

মূল লেখার লিংক

[ডিসক্লেইমারঃ পোস্টে প্রকাশিত লেখার দায় ও মত একান্তই লেখকের নিজস্বঃ]
হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান নামে রাসুলুল্লাহ সাঃ এর একজন বিখ্যাত সাহাবী ছিলেন। একমাত্র তাঁকেই রাসুলুল্লাহ সাঃ তৎকালীন যুগের মুনাফিকদের পরিচয় জানিয়েছিলেন এবং তাঁকে নিষেধ করেছিলেন আর কাউকে তাদের পরিচয় প্রকাশ না করতে। এজন্য সাহাবা, তাবেয়ী এবং ইসলামের পরবর্তি ইতিহাসে তিনি ‘সাহিবুস সির’ বা রাসুলের গোপন জ্ঞানের অধিকারী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি অন্য একটি কারণেও বিখ্যাত ছিলেন। ফিতনা বা বিপর্যয়ের এবং ভ্রষ্টতা-বিশৃংখলার ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাদিসগুলি তিনিই বর্ণনা করেছেন। তিনি নিজেই বলতেন, “সবাই রাসুলুল্লাহ সাঃ কে ভালো কাজ বা ভালো আমলের ব্যাপারে বেশী জিজ্ঞেস করতো আর আমি করতাম ফিতনার ব্যাপারে। নিজেকে ফিতনা থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই আমি সেগুলো জানার চেষ্টা করতাম বেশী”। সহীহ মুসলিমে এই হুজাইফা রাঃ থেকে বর্ণিত হয়েছে ফিতনার সবচেয়ে বিখ্যাত একটি হাদিস। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছিলেন “ফিতনার দরজা একদিন ভেঙে ফেলা হবে (খুলে দেয়া নয়, একেবারে ভেঙে ফেলা, যা কিয়ামাত পর্যন্ত আর ঠেকানো যাবে না)। এই দরজাটি ছিলেন উমার বিন খাত্তাব রাঃ। তাঁর মৃত্যুর পর উম্মাহর ভেতর ফিতনা প্রবেশ শুরু হবে এবং তা কিয়ামাত পর্যন্ত বন্ধ হবে না।

রাসুল সাঃ এর কথা শতভাগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে উমারের মৃত্যুর পূর্বেই। রাসুল সাঃ এর মৃত্যুর পর থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ ফিতনা মোকাবেলা করেছেন আবু বকর রাঃ। রাসুল সাঃ এর ইন্তেকালের পর পর সারা আরবে অল্প কয়েকটি গোত্র বাদে সবাই ইসলাম ত্যাগ করে। এর মধ্যে যারা সবচেয়ে নমনীয় ছিল, তারা শর্ত দিয়েছিল যে, তারা ইসলামের সকল কিছুই মেনে চলবে, কেবল মদীনার কেন্দ্রীয় শাসককে যাকাত দেবে না। নরম হৃদয়ের আবু বকর এই দলগুলোর বিরুদ্ধেও যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভয়াবহতম ফিতনা থেকে রক্ষা করেছিলেন ইসলামকে। তা না হলে পৃথিবীর ইতিহাস হতো অন্যরকম।

উমার রাঃ এর মৃত্যুর পর সত্যিকার অর্থেই ভেঙে যায় ফিতনার বন্ধ দরজা। উসমান রাঃ এর সময় আবদুল্লাহ বিন সাবাহ নামের ছদ্মবেশী ইয়াহুদি স্পাইয়ের মাধ্যমে খলিফা বিরোধী ভয়াবহ ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে থাকে। মুসলিম উম্মাহ প্রথম দেখতে পায় ফিতনা আসন গেঁড়ে বসেছে উম্মাহর ভেতর। এরপর উসমানের মৃত্যু এবং আলী রাঃ এর খলিফা হবার পর থেকে খারেজী ফিরকার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ প্রথম বিভাজিত হয়। এরপর ইবন সাবাহর হাত ধরে আলী রাঃ ও তাঁর উত্তরসূরিদের নিয়ে বাড়াবাড়ির পথ ধরে শিয়া নামের এক বড় বিভাজন উম্মাহর দেহে স্থায়ী ক্ষত হিসাবে যায়গা নেয়। কালক্রমে এই শিয়া মতবাদ থেকে ইসনা আশয়ারী, যায়েদী, ইসমাইলী, নুসরিয়া, ফাতেমীয়া ইত্যাদি পরস্পর বিরোধী মতবাদের উদ্ভব হয়। শিয়া মতবাদ শুধু শিইজমের ভেতর নয়, ইসলামের মূল ধারায় নানা শির্ক, কুফর আর বিদআতের উদ্ভব ঘটিয়ে দ্বীনকে টুকরো টুকরো করে উম্মাহকে বহুধা বিভক্ত করছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এই শিয়া মতবাদ বা শী’ইজম থেকেই উদ্ভব হয়েছে বাহাই ধর্ম বা বাহাই মতবাদ, যা এর ভয়াবহ ভ্রষ্টতার জন্যই খোদ শিয়াদের দ্বারাই ইরান থেকে বিতাড়িত হয়।


বাবিয়া থেকে বাহাইঃ

শীয়া মতবাদের প্রাথমিক যুগে সমকালীন ইমামের প্রধান শিষ্যকে বাব বলা হত। বাবের শাব্দিক অর্থ দ্বার বা দরজা। ইমামের পরেই ছিলো ‘বাব’ এর পদমর্যাদা। বাবী মতবাদের পত্তন হয় সাইয়েদ আলী মুহাম্মদ শিরাজী’র হাত ধরে, যিনি বর্তমান ইরানের শিরাজ নগরে ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন। শিয়া অন্য মতবাদে মাহদী নিয়ে বাড়াবাড়ির মতো একই পথ ধরে এক সময় তিনি নিজেকে প্রতিশ্রুত মাহদী হিসাবে দাবী করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তিনি প্রচার করতে থাকেন যে, আল্লাহ্ তাঁর সাথে কথা বলেন, তার নিকট ওহী আসে এবং তিনি আল্লাহর মনোনীত বাব। ধীরে ধীরে তার সমর্থক সংখ্যা বাড়তে থাকে। শিয়াতন্ত্রের সাথে বিরোধ, ধর্মীয় স্বেচ্ছাচার ও সাংঘর্ষিক মতবাদ প্রচারের কারণে বাবীদের সাথে ইরান শাসক শাহ এর সংঘর্ষ বাঁধে। এক সময় ইরানের শাহ গ্রেফতার করে বাবীদের নেতা সাইয়েদ আলী মুহাম্মাদকে। ১৮৫০ সালের জুলাই মাসে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় তাঁর। মৃতদেহ নিয়ে আসা হয় ইসরাইলের হাইফায়। সেখানেই সমাধিস্ত করা হয় তাঁকে।

বাব এর হত্যাকান্ডের পর দুটো ঘটনা ঘটল।
১/বাবিরা ইরান থেকে নির্বাসিত হল।
২/ বাবের দেখানো পথ থেকে বাহাই আন্দোলনের সূত্রপাত হল।

কিভাবে?

বাব সাইয়্যেদ আলী মুহাম্মাদ যখন বাবী মতবাদ প্রচার শুরু করেন তখন থেকে তাঁর একজন একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন তার চেয়ে দুই বছরের ছোট চতুর এক মন্ত্রীপুত্র। তার নাম ছিলো হুসাইন আলী নূরী। বাব ‘বেয়ান’ নামের একটি গ্রন্থ রচনা করে তাকে বাবীদের ধর্মগ্রন্থ বলে ঘোষণা করেছিলেন। হুসাইন নুরী এই বেয়ান পড়ে দেখতে পান এখানে বাব একজন প্রতিশ্রুত পুরুষের আগমনের কথা বলে গেছেন। তিনি সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। বাবের মৃত্যুর পর অনেক বাবীর সাথে ইরান সরকার একদিন তাঁকেও গ্রেফতার করে তেহরানের একটি কারাগারে বন্দী করে। বন্দী অবস্থাতেই একদিন তিনি ঘোষণা করেন তিনি হলেন বাবের ঘোষিত সেই প্রতিশ্রুত পুরুষ এবং দাবী করেন আজ থেকে তিনি ‘বাহাউল্লাহ’ যার অর্থ ‘আল্লাহ্‌র গৌরব’। সেই থেকে বাবীদের অধিকাংশ অনুসারী বাহাউল্লাহর পক্ষাবলম্বন করে। কিন্তু বাহাউল্লাহর আপন ভাই, যে কিনা বাবীদের একজন একনিষ্ঠ অনুসারী ছিল, বাহাউল্লাহকে ভন্ড বলে আখ্যা দিয়ে বাবীদের দিকেই থেকে যায়। দুই ভাই একে অন্যকে হত্যার কয়েকটি নিস্ফল চেষ্টা চালায়। তবে বাহাউল্লাহ তাঁর সৌম্যদর্শন চেহারা ও মোহগ্রস্থ করা বিভিন্ন কথার জালে বেঁধে ফেলে বাবীদের বৃহত্তম অংশকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। আর সেই থেকে তার বাহাউল্লাহ নাম থেকে তাদের নামকরণ করা হয় বাহাই।

এক সময় ইরানের শাহ উসমানীয় শাসকের সাথে চুক্তি করে তাঁকে নির্বাসনে পাঠায় ইস্তাম্বুলে। উসমানীয় শাসকরাও সময়ে সময়ে তাকে নানা স্থানে নির্বাসনে পাঠায় এবং বন্দী করে রাখে। যদিও বাহাইরা নিজেদের মুসলিম দাবী না করার জন্য নাকি নিছক কুটনৈতিক চাপ বা কুটনৈতিক ব্যর্থতায় উসমানীয় খলিফা তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং বাহাইদের নির্মুল করার মতো শক্ত পদক্ষেপ নেননি সে সত্যটা জানা কঠিন।

শেষ জীবনে বাহাউল্লাহ লিখলেন ‘কিতাব ই আকদাস’, যা বাহাইদের ধর্মগ্রন্থ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯ই মে, ১৮৯২ সালে উসমানীয়দের হাতে বন্দী অবস্থায় বর্তমান ইসরাইলের বাহজী ম্যাসনে মৃত্যুবরণ করেন বাহাউল্লাহ। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে ওয়াসিয়ত নয়ে বিভেদে জড়িয়ে পড়েন ও দুই ভাগে বিভক্ত হয় বাহাই ধর্মমত। আবদুল বাহা নামের ছেলে বাহাই ধর্মের প্রধান অংশের হাল ধরেন।

বাবীদের কি হয়?

বাবিরা এখনও মধ্য এশিয়ায় বাস করে, যদিও সংখ্যালঘু। এখনও স্বপ্ন দেখে তারা-একজন প্রেরিতপুরুষ জন্মাবে ওদের সম্প্রদায় থেকে! মহামতি বাব তো এমন কথাই বলে গেছেন। আর বাহাউল্লা তো আস্ত একটা ভন্ড।


বাহাইদের ধর্মদর্শনঃ

আল্লাহ: সৃষ্টির উর্ধ্বে অবস্থানকারী এক অজেয় সত্তা হচ্ছেন আল্লাহ্। তার কাছে পৌঁছানোর সকল রাস্তা অবরুদ্ধ। এজন্য ‘বাব’ এর প্রয়োজন। যাতে করে তার মাধ্যমে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছানো যায়। বাহাইগণ আতীন্দ্রিয় সর্বোশ্বরবাদের বিরোধী । আতীন্ত্রয়বাদীগণ কেবল তাদের নিজস্ব কল্পনা বা ধারণার চিত্র অঙ্কন করেছেন। এমনকি মহত্তম আত্মা এবং পবিত্রতম হৃদয় তা যতই উচ্চ ও উন্নত হোক না কেন- বিজ্ঞানের ও আধ্যাত্মিকতার জগতে যত উচ্চেই বিচরণ করুক না কেন নিজেদের আভিজ্ঞতার পরিমণ্ডল অতিক্রম করতে পারে না।

সৃষ্টি: আল্লাহ আজ্ঞেয় সত্তারূপে নিজেকে সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত করে।

নবী: আল্লাহ অভিব্যক্তির একটি বিশেষরূপ নবীদের মাঝে ব্যক্ত হয়েছে।

শরিয়তঃ বাহাইগণ তাদের শরীয়তকে পূর্ববর্তী সকল শরীয়তের রহিতকারী বলে উল্লেখ করে।

মা’বুদ: বাহাইগণ সর্বপ্রথম আসমানী ধর্মের দাবিদার হয়ে মানুষের ইবাদাতের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে থাকে। এজন্য তারা তাদের মা’বুদ হিসেবে প্রথম দিকে ‘বাব’ কে মনে করলেও পরবর্তীতে মির্যা হুসাইন আলী ‘বাহা’ কে মা’বুদ হিসেবে মনে করে এবং তাকে আল্লাহ্ পর্যন্ত পৌঁছার দ্বার হিসাবে আখ্যায়িত করে। এবং তাকেই সৃষ্টির উৎস বলে ঘোষণা করে।

কিবলা: বাহাঈগণ জীবিত অবস্থায় ‘বাহা’ কে কিবলা হিসেবে মনে করত, পরবর্তী সময়ে তার কবরকে কিবলা মেনে নিয়েছে। তার পবিত্র কা’বা শরীফকে কিবলা মনে করে না।

সালাত: নামাযকে তারা একটি খেলা মনে করে। তারপরও ঐচ্ছিক ইবাদত হিসেবে নামাযকে তাদের শরীয়তভুক্ত করেছে, সে হিসেবে সালাতের তিনটি সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।
১.বুকুর- (প্রাত কালিন) যাকে তারা কুবরা বলে আখ্যায়িত করে।
২.জাওয়াল (মধ্যাহ্নে) যাকে তারা উসতা বলে থাকে।
৩.আসাল (সাঁয়াহ্ন) যকে তারা সুগরা বলে থাকে।
এ তিনটি সময়ের মধ্যে থেকে একটি সময়ে আদায় করলেই হয়ে যায়। অন্যদিকে ইহুদী, খ্রিস্টান, মুসলমান যে কারো সাথে নামায আদায় করা বৈধ এবং মাত্র ৯ রাকাত হচ্ছে তাদের নামায, মুসাফির কিংবা অসুস্থ লোকের জন্য একটি মাত্র সিজদাই যথেষ্ট। আর বয়োঃজেষ্ট লোকদের জন্য নামায এবং রোযার কোন বিধান নেই। বাহাই মতে প্রকাশ্য দলগত কোন আচার অনুষ্ঠান নেই। তারা নামাযকে ব্যক্তিগত ইবাদাত মনে করে। নামাযের জন্য জামাআতকে তারা অবৈধ ঘোষণা করে। শুধুমাত্র জানাযার নামাযকে সামাষ্ঠিক ইবাদাতে গণ্য করে। তাদের পুরো ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে নামায আদায়ের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা ঠাই পায়নি ।

সাওম বা রোযা : বাহাই মতে সাওম হচ্ছে; প্রত্যুষ থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা। এর অর্থ হচ্ছে: রোজাদার ব্যক্তি পানাহার ব্যতিত সবকিছু করতে পারে এমনকি স্ত্রী সঙ্গম পর্যন্ত বৈধ। রোযার নির্দিষ্ট কোন নিয়ম বর্ণিত হয়নি। যেমন, সাহরী, ইফতার ইত্যাদি, এ রোজা পালন শুধুমাত্র উপবাস পালনের নামান্তর। সময় হচ্ছে, বাহাঈ মতে ‘সাহরুল আলা’ বা আলা মাস, (বাহাঈ মতে বছর ১৯ মাস এবং মাস হয় ১৯ দিন।) যা ইংরেজী মার্চ মাসের ২ তারিখ হয় এবং ২১ তারিখ শেষ হয়।

যাকাত: বাহাঈগণ যাকাতের জন্য আলাদা কোন নিয়ম প্রণয়ন করতে পারে নি। এজন্য তারা যাকাতের জন্য কুরআনের নিয়মকেই মেনে নিয়েছে।

হজ্জ : বাহাঈ মতে হজ্জ হচ্ছে: বাগদাদে অবস্থিত হুসাইন আলী বাহা’র ঘরের হজ্জ করা। আর তা শুধুমাত্র পুরুষদের ওপর ফরজ নারীদের ওপর নয়।

পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা: বাহাই মতে প্রত্যেক জিনিসই পাক। এমনকি বীর্য, উত্তেজিত অবস্থায় নির্গত পানি এবং প্রশ্রাব ইত্যাদি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তারা বলেন যে-সপ্তাহে একদিন গোসল, গ্রীষ্মকালে প্রতিদিন একবার পা ধুয়া এবং শীতকালে তিনদিন পর একবার পা ধুয়া, এর ভেতরে যা কিছু হোক না কেন আলাদা করে পরিচ্ছন্নতা অর্জনের প্রয়োজন নেই।

পরকাল: পরকালের ব্যাপারে বাহাঈগণের মত হচ্ছে; এর স্থায়িত্ব নেই। এমনকি কবরের আজাব, কিয়ামত, পুনরুত্থান, হাশর, নশর, হিসাব, প্রতিদান পূর্ণ-পরিণাম, জান্নাত-জাহান্নাম বলতে কিছু নেই।

সমকামিতা: তারা-নারীর সাথে নারী এবং পুরুষের সাথে পুরুষের সমকামিতার বৈধতার প্রবক্তা।

বিবাহ: বিবাহের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পিতার স্ত্রী ব্যতিত অন্য সকল মহিলাকে বিবাহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বোন, খালা, ফুফু, দুধমাতা, মায়ের মা (ওপরের দিকে), মেয়ে, নাতনী থেকে নিচের দিকে, ভাইয়ের মেয়ে, ছেলের মেয়ে- বোনের মেয়ে, সকলকেই বিয়ে করা বৈধ।

ব্যভিচার ও বহু বিবাহ: বাহাইগণ একসাথে দুই বিয়ে বৈধ করেছেন এর ওপরে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তারা প্রকাশ্যে যিনা করাকে মুবাহ বা বৈধ বলেছেন।

বাহাই স্টান্টবাজিঃ

নিজেদের মতবাদকে শোভন দেখাতে বাহাইরা বেশ কিছু স্টান্টবাজি নিজেদের ধর্মের মূলনীতি হিসাবে প্রকাশ করে যা খুব সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করে। এর ভেতর আছে-

ধর্মীয় ঐক্য: বাহাই মতবাদে সকল ধর্মে এক, সকল ধর্মের মান সমান। এক ধর্মের লোক অপর ধর্মকে বাতিল বলতে পারবে না। সবাই আপন আপন ধর্মকে পালন করার পাশাপাশি অপর ধর্মকে সঠিক বলে বিশ্বাস করতে হবে। অথচ বাহাইগণ নিজেদের ভেতরে ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত। যা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি।

এক দেশ: জাতীয়করণ রোধ করার উদ্দেশ্যে বাহাইগণ এক দেশ হওয়ার দাবি করে থাকেন। তারা মনে করেন পৃথিবীতে আলাদা কোন দেশ থাকবে না। সবাই একই দেশের অধিবাসী। তবে তাদের এ আহ্বান ছিলো শুধুমাত্র লোক দেখানো। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রাশিয়ার সেবা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন রাশিয়ার সাথে ইরানের বিরোধ চরমে তখনই বাহাইগণ নতুন এ দাবি উত্থাপন করে।

এক ভাষা: মানুষের ঐক্য এবং সম্প্রীতির জন্য ভাষিক সমন্বয়তার কোন বিকল্প নেই। এজন্য প্রয়োজন পুরো পৃথিবী জুড়ে একটি ভাষার প্রচলন হওয়া দরকার। যদিও সে ভাষা ‘ফারসী’। তবে বাহ্যত এরকম বললেও তারা নিজেদের ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করেছে আরবী ও ফারসীতে। গরিষ্ঠ মুসলিম জনসংখ্যাকে আকর্ষণ করে দ্বীন থেকে বিচ্যুত করাই তাদের এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।

নারী-পুরুষ সমঅধিকারঃ এক্ষেত্রে এদের স্টান্টবাজি তথাকথিত সুশীলদের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। বাইরে নারীদের সমঅধিকারের ব্যাপারে আওয়াজ তুললেও বাহাই শুরা বা কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদে নারীদের কোন স্থান নেই। কেন্দ্রের সব ব্যাপারে পুরুষরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখে।

বিজ্ঞান ও ধর্মের সামঞ্জস্যঃ বাহাই মতে ধর্ম বজ্ঞানের সাথে সমন্বয় বিধান করে চলবে। কিন্তু ক্রমপরিবর্তনশীল বিজ্ঞানের সাথে সমন্বয় করতে গিয়ে এক্ষেত্রে তারা ছন্নছাড়া অবস্থায় পড়ে। ব্যাপারটা এমন-এই বিজ্ঞানী সত্য বলছেন কিন্তু তিনি বাহাইকে বিশ্বাস করেন না এটা মানা যায় না। বাহাইরা আল্লাহ্‌কে মানে বিজ্ঞানও মানে, কিন্তু অনেক বিজ্ঞানী স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করার থিওরী দিচ্ছেন এটাও মানা যাচ্ছে না………।


বিশ্ব মানচিত্রে বাহাইদের শক্ত অবস্থান ও ক্ষমতাঃ

যেকোন মুসলিম নামধারী ভ্রষ্ট দলকেই পৃথিবীজুড়ে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় ইয়াহুদী নাসারা ও অন্যান্য কুফফার জনগোষ্ঠী। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রে বাহাইদের শক্ত ঘাঁটি ও অবস্থান রয়েছে। বাহাইদের ধর্মীয় সদর দপ্তর হলো ইসরাইলের হাইফায় এর নাম ‘ইউনিভার্সাল হাউজ অফ জাস্টিস’। ২০০৪ সালে প্রকাশিত ‘দি ওয়ার্ল্ড আলম্যানাক এ্যান্ড বুক অফ ফ্যাক্ট’ বলেঃ অধিকাংশ বাহাই এশিয়া মহাদেশে বসবাস করে যা প্রায় ৩৬লাখ (এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ভারতে প্রায় ২২ লাখ এরপরে ইরানে প্রায় তিন লাখ ৫০ হাজার), আফ্রিকায় ১৮লাখ ল্যটিন আমেরিকায়ন নয় লাখ, আমেরিকায় দেড় লাখ। তবে কোন দেশেই সংখ্যাধিক্যের ধর্ম ‘বাহাই’ না।


বাংলাদেশে বাহাইঃ

বাহাইদের এদেশে আগমনের ইতিহাস অনেক পুরনো। বাহাউল্লাহর জীবিত অবস্থায় জামাল এফেন্দী নামের বাহাই প্রচারক প্রথম ভারতে আসেন যিনি কয়েকবার ঢাকা এসেছিলেন। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামের একদল লোক বাহাই ধর্ম্মত গ্রহণ করে। বাংলাদেশে বাহাই জনসংখ্যা বাহ্যিক প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী ১০ হাজার, তবে প্রকৃত সংখ্যা কত তা নিশ্চিত নয়। এদের বেশ কিছু কার্যক্রম পরিচালিত হলেও এরা নিজেদের সরাসরি অমুসলিম পরিচিতি দিয়ে সেসব করে না। ১৯৯৬ সালে বাহাই সদর দপ্তর ‘ইউনিভার্সাল হাউজ অব জাস্টিস থেকে একটি বিবৃতি দেয়া হয় বাংলাদেশের বাহাই সম্পর্কে, যেখানে বলা হয়,

“The Bahá’í community of Bangladesh, flourishing in the midst of a Muslim society, is a source of joy to the entire Bahá’í world. In recent years and with astonishing rapidity, that community began to achieve extraordinary success in the teaching field, and throughout the Three Year Plan it has sustained consistently large-scale expansion. Its institutions have demonstrated their capacity to mobilize the human resources at their disposal, and those who have responded to the call for action have sacrificially and with the utmost devotion spread the Divine Teachings among the Muslim, Hindu and tribal populations of that country. The purity of their motives and the sincerity of their efforts to address the needs of society have won them recognition from government officials in the highest circles. Their exertions to promote love and unity among the majority Muslim and minority Hindu populations are bearing increasing fruit, a striking testimony to the potency of Bahá’u’lláh’s Revelation.”

ঢাকার শান্তিনগরে বাহাইদের ধর্মীয় কেন্দ্র রয়েছে। বাংলাদেশে বাহাইরা অনেক সামাজিক ও উন্নয়নমূলক খাতে কাজ করছে। প্রধানতঃ শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের অনেক কার্যক্রম চলছে। যশোরে তাদের প্রতিষ্ঠিত স্কুল রয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর ২০০৩ সালে বাহাই ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি একটি কনফারেন্স আয়োজন করে যার টাইটেল ছিলো ‘এডুকেশনঃ দ্য রাইট অব এভরি গার্ল এন্ড বয়’, যার সহায়তায় অন্য আরো প্রতিষ্ঠানের সাথে ছিলো বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফ। এছাড়াও এদেশের বাহাই সম্প্রদায় স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম, আন্তধর্ম সংলাপ এবং বাহাই বিশ্বাস ও বিশ্বশান্তির উপর উচ্চপর্যায়ের সেমনার আয়োজন করে আসছে। এদের এসকল কার্যক্রমে কোন সমস্যা নেই যদি এটা তারা নিজেদের একটি ধর্মীয় পরিচয়ে করে। তবে যেহেতু সব ক্ষেত্রে এদেশে বাহাইরা প্রকাশ্য নয়, বরং সাধারণ সমাবেশে তারা তাদের ধর্মীয় পরিচয় গোপন রেখেই সবার সাথে মিশে, সেক্ষেত্রে আর দশটা সাধারণ মুসলিমের মতো আবদুল্লাহ, জামাল, নজরুল ইত্যাদি নাম নিয়ে নিজেদের মতবাদ কৌশলে প্রচার করে, তখন সাধারণ মানুষের বিভ্রান্ত হবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

হক্ব ও বাতিলের দ্বন্দ্ব কিয়ামাত পর্যন্ত থাকবে। আল্লাহ্‌ কুরআনে বলেছেন, “যদি তিনি চাইতেন, তাহলে পৃথিবীর সকল লোক এক জাতি হয়ে তাঁরই আদেশ মেনে চলতো”। কিন্তু আল্লাহ্‌ সেটা চাননি এবং তিনি মানুষকে নিজের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। আর তাই সকল ধর্মই সঠিক বা সকল ধর্ম এক হওয়া উচিৎ-ইত্যাদি গালভরা কথা যত সুন্দরই শোনা যাক না কেন, এর পেছনে অন্তত ইসলাম নেই এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লা আনতা আসতাগফিরুকা ওয়াতুবু ইলাইক।

সূত্রঃ

১। Click This Link
২। Click This Link
৩। Click This Link
৪। Click This Link
৫। Click This Link
৬। Click This Link
৭। http://www.bahaullah.org/
৮। http://www.bahai.us/
৯। ইসলামী বিশ্বকোষ-১৫শ খণ্ড
১০। Click This Link

2 Comments to “মুসলিমদের নাম নিয়ে থাকা অমুসলিমরাঃ ১ – বাহাই ধর্মমত”

  1. বাহা’ই রা তো নিজেদের মুসলিম হলে দাবী করছে না, তাহলে আর সমস্যা কি? আরবি নাম মুসলমান ছাড়াও আরো অনেকেরই আছে। মধ্যপ্রাচ্য খ্রিষ্টান এবং ইহুদীদের নামও আরবীতে হয়। তারা যেহেতু মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছে বা সেখান থেকে উদ্ভূত ধর্মের অনুসারী তারা আরবি নাম ব্যবহার করাতেই পারে। এই লেখকের দেখি একটা আজব ধরনা আছে, আমরা মুসলমান, তার মানে এই না যে আমরাই এইমাত্র আরবি নাম ব্যবহারের অধিকার রাখি। আরবি অনেক পুরাতন একটা ভাষা, এটা ইসলামের চেয়েও পুরানো, সেটা এই লেখকের জানা উচিৎ।

    বি.দ্র.: ইমরানের প্লীজ এই লেখার শুরুতে একটা ডিস্কলেইমার দে, যে এই লেখাটা তোর না, এটা একটা সংগ্রিহিত লেখা।

    • দিয়ে দিলাম।
      বাহাই গোষ্ঠী নিজেদের কি বলে দাবী করছে তার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো তাদের আইডেন্টিটি কি বলছে।
      একটা মানুষের রিলিজিয়াস আইডেন্টিটি বলতে আমরা প্রাথমিকভাবে যেগুলো দেখি তার মধ্যে রয়েছে নাম, ধর্মীয় আচরণ এবং ক্ষেত্রবিশেষে পোশাক। এগুলোর কোনওটিতেই তাদের অবস্থান সুস্পষ্ট নয় বলেই সাধারণ মানুষের পক্ষে সেটা বুঝে নেয়া কঠিন এবং সেটা বিভ্রান্তিরও জন্ম দেয়।

লেখাটির ব্যাপারে আপনার মন্তব্য এখানে জানাতে পারেন