আমার সীমাবদ্ধতাগুলো- পাছে লোকে কিছু বলে

আগের পর্ব

ক্লাস এইটের বিশ্রী সেই বছরটা পার হয়ে যখন নাইনে উঠলাম, আমার মত ‘পিছুটান-প্রবণ’ ছেলের কিছু ক্লাসফ্রেন্ড জাতীয় বন্ধু ততদিনে জুটে গিয়েছে। খুবই স্বাভাবিক, এক বছর হলো তাদের সাথে আছি, এটা ওটা করতে করতে একজন দুজনের সঙ্গে খাতির হয়েই যায়।

আরও অনেকের সাথেই হতো হয়তোবা, হতে পারলোনা শুধু একটা কারণেই, সেটা এই পিছুটান

ছোটবেলায় আব্বু মুরুব্বি কারো সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেবার সময় অন্য যাই’ই বলতেন না কেন, একটা কথা ছিল বাঁধা। ‘ছেলে চঞ্চল। চুপচাপ একটু কোথাও বসে থাকতে পারে না, খালি খুটখাট করে। দোয়া করবেন, যেন ইঞ্জিনিয়ার বানাতে পারি’।

আম্মু বলতেন তার ঠিক উল্টোটা। ‘ছাতার ইঞ্জিনিয়ার হবি তুই, ভাল করে মানুষের সাথে কথা বলতে পারিস না, মিশতে বললে মিশতে পারিস না, তুই হবি ইঞ্জিনিয়ার!…………………’

সত্যি বলতে কি, পিছুটানের এ স্বভাবটা আমাকে ছোটবেলা থেকে ভুগিয়ে আসছে, আজও ভোগাচ্ছে। আব্বু আম্মু এটার পারফেক্ট একটা নাম দিয়েছিলেন, ‘পাছে লোকে কিছু বলে’। কোন কাজ করতে যাব, মনে হলো, আল্লাহ! যদি করতে না পারি। কাউকে গিয়ে ডাক দেবো, মনে হয়, আল্লাহ! যদি আমার ডাক শুনে না আসে।

এই যে এত্তো বড় হয়েছি, সেদিনও, এক বন্ধুর বাসায় নিমন্ত্রণ ছিল। গিয়েছি বাসায়, ঢোকার আগে গেইটে দেখি এত্তো এত্তো জুতার সারি। দেখেই আমার কম্মো সারা, ঢুকার অর্ধেক ইচ্ছা তখনই শেষ। মনে হচ্ছিল, এত্তোগুলো লোকের সামনে যদি আমি ঢুকি, সবাই আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকাবে, দেখবে কোন চিড়িয়া এসেছে। কোনোমতেই বেলটা টেপার সাহস করতে পারলাম না। মোবাইল বের করে দোস্তকে ডায়াল করলাম। শুকনো গলায় চিঁ চিঁ করে বললাম, ‘শালা! আমাকে ভিতরে নিয়ে উদ্ধার কর’। (হাইসেন না ভাই, সত্যি ঘটনা)

মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হলে যা হয় আরকি, দরজা খুললেন আন্টি। বললেন, ‘আসো, ভিতরে আসো। বেল বাজাওনি যে? কোনমতে ঢোক গিলে বললাম, ‘আন্টি, বেলের বাটনটা মে বি কাজ করছে না’। আন্টি আমার সামনে বেল চাপলেন, কর্কশ আওয়াজে বেজে উঠলো। আমি তেলমারা একটা হাসি মারলাম। আন্টি কি বুঝলেন কে জানে, আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।

বড়বেলাতেই এরকম, ছোটবেলার অবস্থা সহজেই অনুমেয়। ক্লাসের কোন একটা ছেলের সাথে নিজে থেকে কথা বলতে পারার সাহস করে উঠতে পারিনি। সবসময় মনে হতো, ও যদি কথা না বলতে চায়!

এ পর্যায়ে এসে সমরেশের ‘গর্ভধারিনী’ বইটা একটা অদ্ভুত রোল প্লে করলো।

সেদিন ছিল স্কুলে বেতন দেয়ার ডেট। বেতনের দিন প্রথম পিরিয়ডে ক্লাস নেয়া হয় না, শুধু বেতন নেয়ার কাজ চলে। তো কাহিনী হলো, আমাদের ক্লাসের এক ছেলে বেতনের জন্য আনা কিছু টাকা হারিয়ে ফেললো। কমবেশি হাজারখানেক হবে। ছেলের তো অবস্থা খারাপ। পারলে ভ্যা করে কেঁদে ফেলে। উপায় না দেখে তাকে বোঝানো হল, ব্যাপার না, তুমি নেক্সট বেতনের দিন টাকা দিয়ে দিও।

স্যার চলে যেতেই রিজভী (বিশালদেহী মাস্তান টাইপের ক্লাসমেট) উঠে দাঁড়ালো। ঘোষণা করলো, ক্লাস শেষে কেউ বাইরে যেতে পারবে না, সবার ব্যাগে সার্চ করা হবে। কথাটা হয়তো সবার জন্য বলা, কিন্তু পুরো কথাটা সে বললো আমার দিকে তাকিয়ে। ভাবখানা অনেকটা এমন, ‘চান্দু, তুমি নতুন পোলা, নিলে তুমিই নিছো’।

তো সবাই লাইন ধরে দাঁড়ালাম। সবার ব্যাগে হাতিয়ে হাতিয়ে খোঁজা হতে লাগলো। আমার বেলায় একটু বেশিই সময় নেয়া হলো, পূরো ব্যাগ উপুড় করে বই-খাতার পাতা খুলে খুলে দেখা হলো। বলাই বাহুল্য, কিছু পাওয়া গেলনা। শুধু আমার না, কারও ব্যাগেই কিছু পাওয়া গেলনা। টাকাটা কোথায় হারালো আল্লাহ মালুম।

ক্লাস শেষে বেরিয়ে যাচ্ছি, পাশ থেকে কে যেন আস্তে করে ডাক দিলো, ‘অ্যাই ছেলে, শোনো’, তাকিয়ে দেখি মোটাসোটা ভালমানুষ চেহারার একটা ছেলে, চোখে ইয়া মোটা গ্লাসের চশমা। কাছে গেলাম। ‘তুমি কি সমরেশের বই পড়?’ বুঝলাম, ব্যাগ ঘাটানোর সময় গর্ভধারিণী টা ওর নজরে পড়েছে। ‘হু পড়ি। তুমিও কি পড় নাকি?’ বললাম আমি।

‘পড়ি মানে! এক্কেবারে নাক লাগাইয়া পড়ি।’ ও এমন ভঙ্গি করে কথাটা বললো, না হেসে পারলাম না। এবং সেইসময় প্রথমবারের মত আমার মনে হলো, আরে, স্কুলটাতো এক্কেবারে খারাপ না!

হৃদয়ের সাথে আমার বন্ধুত্বের সেই যে শুরু, তা টিঁকে ছিল স্কুলের শেষদিন পর্যন্ত, মায় কলেজ পর্যন্ত। গর্ভধারিনী’র চরিত্রগুলোর মতোই আমরা ত্রিরত্ন একে অন্যেকে অসম্ভব বিশ্বাস করতাম, আর পাগলামি টাইপের সব কাজ করতাম।

ত্রিরত্নের আরেকজন, তুষারের কথা, আর ফাঁকি মেরে কক্সবাজার যাওয়ার কথা নাহয় পরের টার্মে বলি।

http://sonarbangladesh.com/blog/chirohorit/10020

লেখাটির ব্যাপারে আপনার মন্তব্য এখানে জানাতে পারেন